আজ ১৮ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১লা মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

সুলেখা আক্তার শান্তার-অহংকার

প্রতিদিন সংবাদ ডেস্ক: রিমি ভালোবাসে সাদামাটা জীবন। বড়লোকের মেয়ে হলেও তার ভেতর কোন অহমিকা নেই। সে মানুষকে খুব
ভালোবাসে। কারো কোন প্রয়োজন পূরণ করতে পারলে মনে প্রশান্তি পায়। এক কথায় বলা যায় সে খুব পর উপকারী।
একদিন এক অনুষ্ঠানে রিমি আর বিলকিস পাশাপাশি বসে অনুষ্ঠান উপভোগ করছিল। আলাপচারিতা অন্তরঙ্গ হয়। অন্তরঙ্গ
থেকে হয় গভীর বন্ধুত্ব। দয়াবতী রিমির বান্ধবী হওয়ার জন্য হাত বাড়ায় বিলকিস। রিমি তা আগ্রহের সঙ্গে গ্রহণ করে।
গরীব হলেও বিলকিস খুব সুন্দরী। এই বৈপরীত্য নিয়ে সে বিব্রত। কারণ সুন্দর আর ভালো জিনিস থাকবে সমৃদ্ধদের
দখলে। দারিদ্র নিয়ে বিলকিস মনে মনে বিব্রত। তার প্রশ্ন, কিছু কিছু মানুষের দখলে অনাবশ্যক ঐশ্বর্যের প্রাচুর্য থাকে
কেন। হাজার মানুষ যাপন করে অমানুষের জীবন। কেউ একাই হাজার মানুষের বিত্ত বৈভব দখল করে বসে আছে। এটা
হওয়া অন্যায় এমন নীতি কথা কথার কথা হয়ে আছে অনন্তকাল। বিলকিসের সাংসারিক সীমাবদ্ধতার কথা রিমি বুঝে।
তাই তার প্রয়োজনের দিকে রিমির সজাগ দৃষ্টি। রিমির উদার আন্তরিকতায় বিলকিসের কুণ্ঠা সংকোচের অবসান হয়।
এভাবে দুইজন দুজনের সঙ্গে আত্মার আত্মীয় বান্ধবী হয়ে যায়। রিমি বলে বিলকিস আমরা হারিয়ে যাবো না তো? থাকবো
আমরা বান্ধবী হয়ে চিরকাল। বিলকিসের উত্তর, হারাবো কেন? তুই হারাতে চাইলেও আমি তো হারাবো না।

এ কথা বলিস না তো, আমার বুক ধরফর করে তোর কথা শুনে। মানুষ কখন কী পরিস্থিতির সম্মুখীন হয় তা কি কেউ হলফ
করে বলতে পারে। মুরুব্বিদের মতো পাকা পাক কথা বলিস না তো! না বলবো না। ঠিক আছে চল তোকে আইসক্রিম
খাওয়াই। দুই বান্ধবী সাদরে দুইজনকে জড়িয়ে ধরে আইসক্রিমের দোকানে যায়। আইসক্রিম খেতে খেতে রিমি বলে, যদি
চাকরি করি এই কলেজেই চাকরি করবো। তুই চাকরি করবি? তোর বাবার কি কোন কিছু কম আছে? এখানে চাকরি
করে যে টাকা পাবি তা তো তোর কয়েকদিনের খরচা। আর বাকি সময়ের খরচা মিটাবি কিভাবে? রিমি বলে, এখানে
বেতন পেয়ে স্যারেরা স্ত্রী সন্তান নিয়ে খুব ভালোভাবেই চলছেন। সমাজে সম্মান নিয়ে তাঁরা বেঁচে আছেন। বিলকিস গম্ভীর
হয়ে বলে, তুই এই কলেজে চাকরি করবি তার অপেক্ষায় রইলাম।

জীবন এক ছন্দে যদি প্রবাহিত হতো অনিশ্চয়তার আশঙ্কা বলে কিছু না থাকতো। রিমির বাবার জীবন তেমনি এক
ঘটনায় হঠাৎ এলোমেলো হয়ে যায়। আসিফ হোসেনের কারবার নিমজ্জিত হয় গভীর সংকটের আবর্তে। ব্যবসায়িক সংকটে
শেষ হয়ে যায় তার ব্যবসা বাণিজ্য। ব্যাংকে বিশাল দেনা। খুবই চরম মুহূর্ত চলছে রিমির বাবা আসিফ হোসেনের। তাদের
ঢাকার বাড়ি বিক্রি করে দায় দেনা শোধ করতে হয়। তার উপর আছে সাংসারিক খরচ। সংকট গভীর থেকে গভীরতর
হতে থাকে। সবকিছু সীমিত করেও চলা অসম্ভব হয়ে পড়ে আসিফ হোসেনের। ঋণের দায় মিটিয়ে তাদের গ্রামে চলে যেতে
হয়। রিমি আর বিলকিসের আর দেখা হয় না।‌ পরিস্থিতি যেমনই হোক রিমি চলতে কোন সমস্যা হয় না, সে পরিস্থিতি
মেনে নিয়েছে। খুব মিস করে সে কলেজ ভার্সিটির বন্ধু বান্ধবীদের।

সময় বসে থাকে না, অলক্ষে দিন মাস বছর পেরিয়ে যায়। রিমি পুরনো ছবির অ্যালবামটা নাড়াচাড়া করে। ছবিগুলো
দেখে অতীতের কথা মনে পড়ে যায়। একদিন ওরা কত আপন ছিল। আজ তাদের সাথে দেখা নাই কথা নাই। কে কোথায়
আছে তাও অজানা। আজ সে এক ছেলে এক মেয়ের মা। স্বামী পাবন ডাকে স্ত্রীকে, কই তুমি? তোমার কলেজে যাওয়ার
সময় হয়ে গেল। রিমি বাস্তবে ফিরে আসে। চশমাটা চোখে দিয়ে বলে, এইতো আসছি। বাচ্চাদের স্কুলে দিয়ে তোমার তো
আবার কলেজে যেতে হবে। পাবন জানো? পুরনো দিনের কথা মনে পড়ে গেল। আমি যখন এই কলেজে পড়তাম তখন
আমার মন চেয়ে ছিল আমি এই কলেজে চাকরি করব। কিন্তু আমার বান্ধবী বিলকিস আমার কথায় পাত্তাই দেয়নি। আজ
আমি সত্যিই সেই কলেজে শিক্ষকতা করছি। রিমি কলেজে যায়। পুরনো স্মৃতি ভেসে ওঠে মানসপটে। আহ সেই জীবন কত
না মধুর সুখের ছিল।
কলেজের ছাত্রী আনিকার খুব পছন্দ ম্যাডাম রিমি। রিমিকে কলেজের ছাত্র ছাত্রী সবাই পছন্দ করে। রিমি ও কলেজের ছাত্র
ছাত্রীদের সস্নেহে আপন করে নেয়। একদিন আনিকা তার জন্মদিনের আমন্ত্রণ করে ম্যাডাম রিমিকে। আনিকা
নাছোড়বান্দা সে ম্যাডামের স্বীকারোক্তি নিয়ে ছাড়ে। তার জন্মদিনে ম্যাডামকে যেতেই হবে। আনিকার আবদারের কাছে
রিমি কিছুতেই না বলতে পারে না। আনিকার জন্মদিনে রিমি যায় তাদের বাড়িতে।

বাড়িতে প্রবেশ করতেই রিমির চোখ আটকে যায় বাড়ির সাজসজ্জায়। বিশাল বাড়ি অনেক সুন্দর কারুকাজ। বাড়িতে
ঢুকতেই রিমি আশ্চর্যের উপর আশ্চর্য! দেখে বান্ধবী বিলকিসকে। রিমি আবেগে জড়িয়ে ধরে তাকে। জানিস এতদিন পর
তোকে পেয়ে আনন্দে আমি আত্মহারা। তোকে যে এইভাবে আমি পাব ভাবতেও পারিনি! তোর কি আমার কথা মনে
আছে? আমি কিন্তু তোকে ভুলিনি! রিমি এক নিঃশ্বাসে বলে যায় কোন কথা বলার সুযোগ না দিয়ে। বিলকিস ঝটকা মেরে
হাত ছাড়িয়ে নেয়। কে আপনি আমাকে ধরেছেন? বিলকিস আমি রিমি! আমি তোর কলেজের বান্ধবী রিমি। এভাবে
আমাকে ধরা আপনার ঠিক হয় নাই। ইস কী কম দামের শাড়ি! চুল এলোমেলো, দেখতে কেমন! আর আমি আগেও দেখতে
যেমন সুন্দরী ছিলাম এখনো তেমনই আছি। আমি আপনার কোন কথা শুনতে চাই নাই। আর কোন কিছু জানতে চাইও
না। বিলকিস তুই কি সত্যিই চিনতে পারছিস না আমাকে? তুই আমি যেই কলেজে পড়তাম আমি সেই কলেজেই চাকরি
পেয়েছি। বিলকিস বলে, আপনি যেটাকে এত বড় মনে করে বলছেন, সেটা একটা তুচ্ছ বিষয়!

আনিকারা বিলকিসের ভাড়াটিয়া। ম্যাডামকে তাড়াতাড়ি সেখান থেকে ডেকে নিয়ে যায়। আনিকা খুব মন খারাপ করে
বাড়িওয়ালী তার টিচারের সঙ্গে এমন করায়। ব্যাপারটায় তেমন কিছু মনে করেনি রিমি।‌ আনিকার মা পলি খুব
আন্তরিকতায় আপ্যায়ন করে মেয়ের শিক্ষকে। রিমি বলে আমাকে নিয়ে এত ব্যস্ত হওয়ার কিছু নেই। ম্যাডাম আপনি
এসেছেন আমি খুবই খুশি! আমার মেয়ে তো আপনার জন্য খুবই পাগল। আপনি না আসলে আমার মেয়ে খুবই মন খারাপ
করতো। আনিকা আমাকে একটু বেশিই ভালবাসে। আনিকা তখনই বলে ওঠে, ম্যাডাম শুধু আমি না আপনাকে সবাই
ভালোবাসে। আনিকার জন্মদিনের কেক কাটা, খাওয়া-দাওয়া শেষে সবাই বিদায় নেয়। রিমিও বলে এবার আমি চলি।
এতকিছুর মাঝেও মনটা তার বিষন্ন। মাথায় ঘুরতে থাকে বিলকিসের অদ্ভুত আচরণের কথা।

রিমি বলে আমার বান্ধবীর সঙ্গে একটু দেখা করে যাই। বাড়িওয়ালার দরজা নক করে। কাজের মেয়ে দরজা খুলে দিয়ে
বিলকিসকে খবর দেয়। বিলকিস বিরক্ত নিয়ে বলে আমাকে ডাকাডাকির কী আছে? কাজের মেয়েকে ধমক দেয়। রিমি
বলে, বিলকিস তোর শরীর খারাপ? আমার শরীরও খারাপ না মনও খারাপ না। মানুষে মানুষে কথা হয় সমানে সমান।
আমার হাজব্যান্ড বড় বিজনেসম্যান। আমি এই আলিশান বাড়ির মালিক। তাও একটানা কয়েকটা বাড়ির মালিক! এজন্য
তুই আমার সঙ্গে কথা বলতে চাস না? তুই ছিলি আমার প্রাণের বান্ধবী। কলেজে পড়া অবস্থায় যেমন পেয়েছিলাম এখনও
তোকে তেমনি ভেবেছিলাম। আমি তোর কাছে কোন কিছুর জন্য আসিনি। একজন বান্ধবীর জন্য অপর বান্ধবীর হৃদয়ের
আকুতি নিয়ে এসেছিলাম। ক্ষুব্ধ কন্ঠে বিলকিস বলে, একটা কলেজ টিচার কত টাকাই বা বেতন পায়? সেই পরিমাণ টাকা
আমি মিনিটে খরচ করি। বাহ নিজেকে নিয়ে এত গরিমা? তোর এক মিনিটের খরচের টাকায় একটা পরিবার পুরো মাস
স্বচ্ছন্দে চলে। ওই টাকা তাদের আশা-ভরসা ওই টাকা দিয়ে তাদের ভরণপোষণের সব চাহিদা মিটে। আর একজন টিচার
কোন অবজ্ঞার ব্যক্তি নয়, মানুষ গড়ার কারিগর। যে টিচারকে তুই অবজ্ঞা করছিস তাদের দিয়ে হাজার লক্ষ মানুষ
আলোকিত হচ্ছে। যে কলেজ নিয়ে তুই অবজ্ঞা করছিস সেই কলেজে একদিন তোর পড়ার খরচ ছিল না! বিলকিস প্রচন্ড
বিরক্তির সঙ্গে বলে, আজ সেই গৌরব ফলাও করতেই কি এসেছিস? আমি পিছনে কথা মনে করতে চাই না। আমার অতীত
নাই। এখন যে বর্তমান, বর্তমান আর ভবিষ্যতকে নিয়েই ভাবি অতীতের কথা ভাবি না। রিমি ভাবে বিলকিস মনে হয়
মানসিকভাবে সুস্থ নয়। তার আগেই বুঝা উচিত ছিল। রিমি দ্রুত বের হয়ে যায় সেখান থেকে। আনিকা জানায়, উনি
প্রায় সময় চুপচাপ থাকেন। উনাদের বাসা থেকে রাতে মাঝে মাঝে চিৎকারের শব্দ শুনতে পাই। রিমি বুঝতে পারে
বিলকিস সাংসারিক অশান্তিতে বিপর্যস্ত।

এদিকে বিলকিসের বাবা মেয়ের বিয়ের ঘটক মজিদ মিয়াকে দোষারোপ করে। বিলকিসের স্বামী প্রতিদিন মদ খেয়ে
বাড়িতে অশান্তি সৃষ্টি করে। মজিদ বলে, বড়লোক জামাই খোঁজ করেছিলেন। বড়লোকেরা মদ খাবে না তো গরিবরা খাবে?
বড়লোকদের অনেক টাকা! শুধু ভাত খেয়ে কি ওই টাকা শেষ করা যায়? তাইতো মদের মতো দামি জিনিস তাদের খেতে
হয়। মজিদ মিয়া স্বতঃসিদ্ধ কথাটা আবার বলে, টাকার হয়েছে বিপদ, থাকলে অশান্তি না থাকলে আরো বেশি অশান্তি।

Comments are closed.

     এই ক্যাটাগরিতে আরো সংবাদ